‘প্রিয় বাবা, কেমন আছো আমরা ভালো নেই’

কক্সবাজারের টেকনাফে র্যাবের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে টেকনাফ পৌর কাউন্সিলর একরামুল হক নিহত হওয়ার ঘটনায় মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে সেখানকার আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীদের মধ্যে। তারা কথিত বন্দুকযুদ্ধে একরামুল হকের মৃত্যুর ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্তের দাবি জানিয়েছেন। এলাকাবাসীর দাবি, কাউন্সিলর একরামুল হক ইয়াবা ব্যবসায় সংশ্লিষ্ট নন, তার অর্থনৈতিক অবস্থাও খুব খারাপ ছিল। ওদিকে একরামুল হক মৃত্যুর ঘটনায় তার দু-একটি আবেগঘন খোলা চিঠি লিখেছেন।

গত শনিবার রাত সাড়ে ১২টায় কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়কে র্যাবের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন টেকনাফ পৌরসভার কাউন্সিলর একরামুল হক। তিনি টেকনাফ পৌরসভার কায়ুকখালীপাড়ার মৃত আবদুস সাত্তারের ছেলে এবং একই ওয়ার্ডের পর পর তিনবার নির্বাচিত কাউন্সিলর। টেকনাফ উপজেলা যুবলীগের সাবেক সভাপতি।

একরামের ভাই এহসানুল হক বাহাদুর জানান, একটি গোয়েন্দা সংস্থার পরিচয় দিয়ে সাদা পোশাকের কিছু লোক শনিবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে তার ভাইকে ডেকে নিয়ে যায়। যাওয়ার সময় বলেন, জমি বিক্রির ব্যাপারে তারা একরামুলের সঙ্গে কথা বলতে চায়। কিন্তু পরে তার ভাইয়ের মৃত্যুর খবর পান।

একরামের স্ত্রী আয়েশা খাতুন জানান, কোনোকালেই একরাম ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ছিল না। তার বিরুদ্ধে মামলাও নেই।
একই কথা বলেছেন টেকনাফ থানার ওসি রনজিত কুমার বড়–য়া। তিনি জানান, নিহত পৌর কাউন্সিলরের বিরুদ্ধে দুইটি মামলা ছিল, যার একটি মারামারির, অপরটি মাদক আইনে। মারামারির মামলাটি আদালতে শেষ হয়েছে। মাদকের মামলাটি তার সংশ্লিষ্টতা পাওয়া না যাওয়ায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়।

স্থানীয় সাবেক এমপি আবদুল গনির ছেলে সাইফুদ্দিন খালেদ বলেন, ‘আমার চাচাতো ভাই একরামুল হক বাস্তবে ইয়াবার বিরুদ্ধেই সোচ্চার ছিলেন সব সময়। আমাদের পরিবারের সঙ্গে এমপি বদির পরিবারের সম্পর্কও মোটেই ভালো নেই। এ কারণেই আমার ভাই বলি হলেন কিনা আমাদের সন্দেহ।

একরাম নিহত হওয়ার পর কক্সবাজার জেলাব্যাপী আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগসহ বিভিন্ন সচেতন মহল বিরূপ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লিখছেন। তার মধ্যে প্রধানমন্ত্রী বরাবর খোলা চিঠি লিখেছেন কক্সবাজার পৌরসভার ভারপ্রাপ্ত মেয়র, জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মাহবুবুর রহমান। তিনি এ বিষয় তদন্ত করার দাবি জানিয়েছেন।

টেকনাফ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য মোহম্মদ আলী জানান, একরামের মৃত্যুর বিষয়টি টেকনাফের মানুষ সহজভাবে নিচ্ছে না। এটার কোথাও ভুল রয়েছে। বিষয়টি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে পরিষ্কার করা জরুরি।

টেকনাফ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. নুরুল বশর জানার, পৌর কাউন্সিলর একরাম তার বাড়ির নির্মাণ করাও শেষ করতে পারেননি। নিজের সন্তানের স্কুলের বেতন দিতেও হিমশিম খেতে হয়েছে তাকে। তিনি ইয়াবা ব্যবসায়ী, এটা হাস্যকর বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

টেকনাফ পৌর বিএনপির সভাপতি আবদুর রাজ্জাক বলেন, ‘একরাম ইয়াবার সঙ্গে সম্পৃক্ত রয়েছে এমন কথা কোনোকালেই আমরা শুনিনি।

জানা গেছে, টেকনাফ পৌরসভার মরহুম আব্দুস সাত্তার ছিলেন জমিদার। তার চতুর্থ সন্তান হলেন একরামুল হক। বাবা মারা যাওয়ার পর সবাই আলাদা হয়ে যাওয়ায় ধীরে ধীরে সম্পত্তিগুলো শূন্যের কোটায় চলে আসে। বাবার পৈতৃক বাড়ি থেকে ভাগাভাগির মাধ্যমে উত্তরাধিকার সূত্রে একটু পান একরাম। একরামের দুই মেয়ে।

দুজনই টেকনাফ বিজিবি স্কুলে পড়াশোনা করে। এর মধ্যে বড় মেয়ে অষ্টম শ্রেণিতে আর ছোট মেয়ে সপ্তম শ্রেণিতে। পৈতৃকভাবে পাওয়া ছোট্ট বাড়িতে দুই মেয়েকে নিয়ে গাদাগাদি করে বসবাস করতেন একরামুল হক। তার সম্পতি বলতে ছিল শুধু একটি মোটরসাইকেল এবং একটি কালো চশমা। ওই মোটরসাইকেলে দুই মেয়েকে প্রতিদিন স্কুলে পৌঁছে দিতেন আর নিয়ে আসতেন।

এদিকে কথিত বন্দুকযুদ্ধে একরাম নিহত হওয়ার পর তার দুই কন্যা তাহিয়াদ আর নাহিয়ান এখন কোনো কথা বলতে পারছে না। একটু পর পর বাবা বলে জ্ঞান হারিয়ে ফেলছে। তারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাদের আকুতি আর আবেগ দিয়ে এক খোলা ছিঠি লিখেছে। তাতে তারা লিখেছেÑ ‘প্রিয় বাবা, কেমন আছো তুমি! নিশ্চয় অনেক ভালো আছো। আমরা কিন্তু ভালো নেই। কারণ আমাদের পুরো পৃথিবীটা যে তোমাকে ঘিরেই ছিল।

সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর থেকে তোমার কাজ ছিল তোমার রাজকন্যাদের রেডি করা। বাইকে করে প্রাইভেট পড়তে নিয়ে যাওয়া। স্কুলে পৌঁছে দেওয়া। জান বাবা, বাড়িতে অনেক মানুষ চাচা-চাচি, জেঠু-জেঠিমা, ফুফি-ফুফা আর বাড়িভর্তি কাজিনরা। সবার মাঝে তোমার ছায়া খুঁজে চলছি আমরা দুই অনাথ রাজকন্যা। বারবার রাজকন্যা বলছি, কারণ তোমার চোখে আমরা রাজকন্যাই ছিলাম।

হয়তো খুব বেশি প্রাচুর্যপূর্ণ ছিল না আমাদের জীবন, কিন্তু কখনো কোনো কিছুর অভাব তুমি বুঝতে দাওনি আমাদের। আমাদের ছোট বড় সব চাওয়া তোমার কাছে প্রাধান্য পেয়েছে সবার আগে।

সবার মুখে শুনেছি, তোমার জানাজায় প্রচুর মানুষের জমায়েত হয়েছিল, ইসলাম ধর্মে মেয়েরা সেখানে যেতে পারে না, তাই আমাদের দেখা হলো না স্বচক্ষে, তুমি কতটা জনপ্রিয় ছিলে সবার কাছে।

হয়তো ঈদের পর থেকে আমাদের স্কুলবাস নিয়ে যাতায়াত করতে হবে। সে সময় তোমাকে অনেক মিস করব। তোমার শরীর থেকে বাবা-বাবা একটা ঘ্রাণ আসত, খুব মিস করব সে ঘ্রাণ।

তোমার গানের গলা যথেষ্ট প্রশংসনীয় ছিল। আমাদের আবদারে সব গান গেয়ে শুনাতে। মিস করব সে দরাজ ভরা কণ্ঠের গান।
তোমার ভালো মানের চশমার প্রতি লোভ ছিল। তোমার রেখে যাওয়া সে সব চশমা আমাদের দিকে জ্বলজ্বল করে নির্বাক হয়ে তাকিয়ে আছে।

এই কিশোর বয়সে হারিয়ে ফেলব, তা কল্পনাতীত ছিল। কিন্তু আল্লাহ্ তোমাকে নিয়ে গেলেন। হয়তো উনি তোমাকে আমাদের চেয়ে বেশি ভালোবাসেন।

বাবা, তোমার অসমাপ্ত স্বপ্ন আমরা পুরা করব। তোমার দেখিয়ে দেওয়া পথে আমরা আজীবন চলব।
তোমাকে কথা দিলাম, আমরা তোমার সত্যিকার রাজকন্যা হয়ে তোমার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করব। ওপরে অনেক ভালো থেকো বাবা।’